নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
আরবী হিজরী বর্ষের প্রথম মাস মহররম মাস। এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাসে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। এ মাসে রয়েছে আশুরা। আশুরা আরবি শব্দ। আশিরুন এর বহুবচন। এর অর্থ দশম তারিখের সমন্বয় অর্থা মহররম মাসের দশ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলী। পৃথিবীর আদি-অন্তের ঘটনা সাথে আশুরার সম্পৃক্ত রয়েছে। মহররমের দশম দিবসে সংঘটিত বহু ঘটনা হতে কয়েকটি হলোঃ
১। আশুরার দিনে হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয় এবং এই দিনে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। এই তারিখেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে প্রেরিত হন এবং বহু বছর পর এই তারিখেই আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে তিনি ও বিবি হাওয়া (আ.)-এর পুনরায় সাক্ষাত লাভ হয় এবং তাঁদেরকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মার্জনা করা হয়।
২। এ দিবসে হযরত ইদ্রিস (আ.) কে আকাশে উত্তোলন করা হয়।
৩। এ তারিখে হযরত নূহ (আ.) কে তুফান ও প্লাবনের পানি হতে পরিত্রাণ দেয়া হয়।
৪। এ দিনে হযরত আইয়ুব (আ.) কে ১৮ বছর রোগ ভোগের পর রোগ মুক্তি দেয়া হয়।
৫। এ তারিখে হযরত ইব্রাহিম খালীলুল্লাহ (আ.) কে অগ্নিকুণ্ড হতে নিষ্কৃতি দেয়া হয়।
৬। এ দিনে হযরত দাউদ (আ.) কে বিশেষ ক্ষমা করা হয় এবং হযরত সুলাইমান (আ) কে স্বীয় হারানো বাদশাহী পুনরায় প্রদান করা হয়।
৭। এ দিবসে হযরত ইউনুছ (আ.) কে ৪০ দিন পর মাছের উদরে থাকার পর নিস্কৃতি দেওয়া হয়।
৮। আশুরায় হযরত ইয়াকূব (আ.) স্বীয় হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) এর সাক্ষাত লাভ করেন।
৯। এ দিনে হযরত মূসা (আ.) ফিরাউনের কবল থেকে নিস্কৃতি লাভ করেন।
১০। এই তারিখে হযরত ঈসা (আ.) কে আকাশে উত্তোলন করা হয়।
১১। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) মক্কা শরীফ হতে হিজরত করে মদীনা শরীফে এ দিনে তাশরীফ নেন।
১২। এ দিনেই নবী করীম (স.)-এর কলিজার টুকরা ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণি হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর ৭৭ জন পরিজন ও ঘনিষ্ঠজন জালিম ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে নির্মমভাবে শহীদ হন। এ মাসের পবিত্রতা ও আশুরার বিশেষত্ব সম্পর্কে আল-কুরআনুল-কারীম ও হাদীস শরীফের কয়েকটি উদ্ধৃতিঃ
ইসলামের হারাম চারটি মাসের একটি হল মহাররম। বর্ষ গণনার রীতি ও মাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করার দিনে মাসসমূহের গণনা আল্লাহর নিকট বার মাস, তন্মধ্যে চারটি হারাম মাস। তোমরা নিজেদের মধ্যে এসবের যুল্ম করো না। আর তোমরা মুশরিকদের সাথে ব্যাপকভাবে যুদ্ধ কর যেমনিভাবে তারা তোমাদের সাথে ব্যাপকভাবে যুদ্ধ করে, আর জেনে রাখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গেই রয়েছেন’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৩৬)।
মহররম মাসে যুদ্ধ হারাম। তবে যদি প্রতিপক্ষ কাফির-মুশরিক চড়াও হয় এবং আক্রমণ করে তাহলে যুদ্ধ করে তাদেরকে ঘায়েল করা বৈধ।
এ প্রসঙ্গে মুকাতিল ইব্ন হায়্যান ও ইব্ন জুরাইজ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবীগণের একদল মহররম মাসে মুশরিকদের একদল লোকের সাক্ষাত লাভ করেন। তখন মুসলিম পক্ষ প্রতিপক্ষকে নিবৃত্ত রাখতে চাইলেন, যাতে তারা হারাম মাসে যুদ্ধ না করে। তারপর মুশরিক পক্ষ অস্বীকৃতি জানিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হতে প্রতিজ্ঞ হল এবং অকস্মাত্ তাদের ওপর চড়াও হল। তখন মুসলিমগণ তদের প্রতিহত করলেন এবং যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। এরপর মহান আল্লাহ তাঁদেরকে বিজয় দান করেন (ইবন কাছীর, তাফসীরে ইবন কাছীর, ৫ম খন্ড, ৪৪৯)।
হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন মাদীনা শরীফে তাশরীফ আনেন তখন সেখানের ইহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোজা রাখা অবস্থায় পেলেন। তাদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলল, এদিন আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আ,) কে ফিরাউনের ওপর বিজয়ী করেন। তাই সেদিনের সম্মানার্থে আমরা রোজা পালন করি। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, মূসা (আ.) এর ব্যাপারে এদিনে রোজা রাখার ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার (ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪২৮ পৃ. হাদীস নং ২০৮৮)।
হযরত আবূ কাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত, একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে বর্ণিত হয়েছে হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাযহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আশুরার দিনের রোযার পুণ্যে আমি আশা করি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ আল্লাহ মোচন করে দেন (ইমাম মুসলিম, আসসাহীহ, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৫৫ পৃষ্ঠা, হাদীস নং-১৯৭৬)।
মাসে বিশেষত ইসলামের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া উচিত। হযরত রসূলুল্লাহ (স.)-এর প্রতি অধিক সংখ্যক দরুদ ও সালাম পেশ, নফল নামায, কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত, আশুরা এবং অন্যদিনেও রোজা পালন, হাদীস শরীফ অধ্যয়ন, দান-সাদকাহ ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে এ মাসে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ করা যায়। আর কারবালার নির্মম ঘটনা দ্বারা ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের দীক্ষা নেওয়া যায়। অন্যায়কে প্রতিহত করে সত্যকে আঁকড়ে থাকার শিক্ষাও আমরা গ্রহণ করতে পারি।
চার সম্মানিত মাসের প্রথম মাস মহররম, যাকে আরবের অন্ধকার যুগেও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হতো। আবার হিজরি সনের প্রথম মাসও মহররম।
শরিয়তের দৃষ্টিতে যেমন এ মাসটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণও অনেক দীর্ঘ।
আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী মহররম মাস। ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয় এ মাসে। শুধু উম্মতে মুহাম্মদিই নয়, বরং পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবীদের অবিস্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এই মাসে।
মহররম মাসের ফজিলত
নামকরণ থেকেই প্রতীয়মান হয় এ মাসের ফজিলত। মহররম অর্থ মর্যাদাও তাৎপর্যপূর্ণ।
যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ মাসকে ঘিরে। সঙ্গে সঙ্গে এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল এসব কারণেই এ মাসটি মর্যাদাপূর্ণ। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে মহররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস।
মহররম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার
লেখকঃ এহছানুল হক
নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক ভোরের বাংলা